একটি জীব থেকে একটি নির্দিষ্ট জিন বহনকারী ডিএনএ খণ্ড পৃথক করে ভিন্ন একটি জীবে স্থানান্তরের কৌশল হচ্ছে জিন প্রকৌশল (Genetic engineering)। আরও সহজভাবে বলা যায়, কাঙ্ক্ষিত নতুন একটি বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির জন্য কোনো জীবের ডিএনএর পরিবর্তন ঘটানোকে জিন প্রকৌশল বলে। এই জিন যে কৌশলগুলোর মাধ্যমে স্থানান্তর করা হয়, তাদের একত্রে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ কৌশল বলে। এই কৌশল অবলম্বন করে একটি ডিএনএ অণুর কাঙ্ক্ষিত অংশ কেটে আলাদা করে অন্য একটি ডিএনএ অনুতে প্রতিস্থাপন করার ফলে যে নতুন ডিএনএ অণুর সৃষ্টি হয়, তাকে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ বলে। রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ তৈরির প্রক্রিয়াকে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রযুক্তি বা জিন ক্লোনিং বলা হয়।
এই প্রযুক্তির মাধ্যমে DNA-এর কাঙ্ক্ষিত অংশ ব্যাকটেরিয়া থেকে মানুষে, উদ্ভিদ থেকে প্রাণীতে, প্রাণী থেকে উদ্ভিদে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছে। জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে উৎপন্ন নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবের কোনো কোনোটিকে বলা হয় GMO (Genetically Modified Organism) আর কোনোটিকে বলে ট্রান্সজেনিক (Transgenic)।
জিএমও এবং ট্রান্সজেনিক জীব এক নয়। জীবের জিনে মিউটেশনের মাধ্যমে বা অন্য যেকোনো উপায়ে যেকোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটলেই সেটিকে জেনেটিক মডিফিকেশন বলে। মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে অর্থাৎ জেনেটিক্সের নিয়ম আবিষ্কারের আগে থেকেই কৃত্রিম নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জেনেটিক্যালি মডিফায়েড কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নতুন জাত উদ্ভাবন করে আসছে। প্রকৃতিতেও অনুরূপ প্রক্রিয়া চলছে লক্ষ-কোটি বছর ধরে, যার নাম জৈব বিবর্তন। জীবপ্রযুক্তির কল্যাণে এই জেনেটিক মডিফিকেশনের ব্যাপারটি আরও নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং কম সময়ে করা সম্ভব। এভাবে যে জীব উৎপন্ন হয়, সেটি জিএমও বা জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম। আর ট্রান্সজেনিক জীব বলতে সেসব জীবকে বোঝায়, যাদের জিনোমে এমন এক বা একাধিক জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা অন্য কোনো প্রজাতি থেকে নেওয়া।
মানুষের অন্ত্রে বসবাস করে একধরনের ব্যাকটেরিয়া, যার নাম Escherichia coli। এই ব্যাকটেরিয়ার উপর গবেষণা করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধিকাংশ কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রযুক্তি নিচে উল্লেখ করা ধাপগুলো (চিত্র 14.02) অবলম্বন করে সম্পন্ন করা হয়:
(a) প্রথমে দাতা জীব থেকে কাঙ্ক্ষিত জিনসহ ডিএনএ অণুকে পৃথক করা হয়। এরপর এই জিনের বাহক বা ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ব্যাকটেরিয়ার প্লাজমিড ডিএনএ পৃথক করা হয়। প্লাজমিড হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া কোষের ক্রোমোজোমের বাইরে আরেকটি স্বতন্ত্র ডিএনএ অণু, যেটি বিভাজিত হতে পারে বা স্ববিভাজনে সক্ষম।
(b) এ ধাপে প্লাজমিড ডিএনএ এবং দাতা ডিএনএকে এক বিশেষ ধরনের এনজাইম বা উৎসেচক দিয়ে খণ্ডিত করা হয়। দাতা ডিএনএ এর এসব খণ্ডের কোনো একটিতে কাঙ্ক্ষিত জিনটি থাকে।
(c) এ ধাপে লাইগেজ নামক একধরনের এনজাইম দিয়ে দাতা ডিএনএকে প্লাজমিড ডিএনএ-এর কাটা প্রান্ত দুটোর মাঝখানে স্থাপন করা হয়। লাইগেজ এখানে আঠার মতো কাজ করে। এর ফলে নির্দিষ্ট জিনসহ রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্লাজমিড তৈরি হয়। এই রিকম্বিন্টেন্ট প্লাজমিড এখন দাতা ডিএনএর খণ্ডিত অংশ বহন করে।
(d) এখন এই রিকম্বিনেন্ট প্লাজমিডকে ব্যাকটেরিয়ার ভিতরে প্রবেশ করানো হয়। খণ্ডিত ডিএনএ গ্রাহক কোষে প্রবেশ করনোর পদ্ধতিকে ট্রান্সফরমেশন বলে। ট্রান্সফরমেশনের ফলে নতুন জিন নিয়ে যে ব্যাকটেরিয়া বা জীবের উদ্ভব ঘটে, তাকে ট্রান্সজেনিক জীব বলে।
(e) এবার নির্দিষ্ট জিন বহনকারী রিকম্বিনেন্ট প্লাজমিড ধারণ করা ব্যাকটেরিয়াকে শনাক্ত করে আলাদা করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট জিন বহনকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোর ব্যাপক বংশবৃদ্ধি ঘটানো হয়। এই ব্যাকটেরিয়াগুলোর প্রত্যেকটিতে এখন কাঙ্ক্ষিত জিন রয়েছে। এই পদ্ধতিতে জিন তৈরি করাকে বলা হয় জিন ক্লোনিং। জিনকে ব্যবহার করার জন্য প্লাজমিডকে আবার আলাদা করে নেওয়া হয়।
আধুনিক জীবপ্রযুক্তি বা জিন কৌশলের মাধ্যমে জিন স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য অল্প সময়ে সুচারুভাবে স্থানান্তর করা সম্ভব হয় বলে সংশ্লিষ্ট উদ্ভাবক বা উদ্যোক্তাগণের নিকট প্রচলিত প্রজননের তুলনায় এ প্রযুক্তিটি অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে।
নতুন ফসল উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রজননের তুলনায় জিন প্রকৌশল অনেক বেশি কার্যকরী, কারণ প্রচলিত প্রজনন প্রক্রিয়ায় জিন স্থানান্তর একই অথবা খুব নিকটবর্তী প্রজাতির মাঝে সীমাবদ্ধ, কিন্তু জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে নিকটবর্তী বা দূরবর্তী যেকোনো প্রজাতির মাঝে এক বা একাধিক জিন সরাসরি স্থানান্তর করা সম্ভব। প্রচলিত প্রজননে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। জিন প্রকৌশলের সাহায্যে খুব দ্রুত কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদ, প্রাণী বা অণুজীব পাওয়া সম্ভব। প্রচলিত প্রজননে কাঙ্ক্ষিত জিনের সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত জিনও স্থানান্তর হয়ে যেতে পারে এবং কাঙ্ক্ষিত জিনের স্থানান্তরও অনেক খানি অনিশ্চিত। জিন প্রকৌশলে অনাকাঙ্ক্ষিত জিন স্থানান্তরের সম্ভাবনা নেই এবং কাঙ্ক্ষিত জিন স্থানান্তরের সম্ভাবনা অনেক বেশি। প্রচলিত প্রজনন কোনো রকম জীবনিরাপত্তা (Biosafety) নিয়ম পদ্ধতি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত নয় কিন্তু জিন প্রকৌশলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জীবনিরাপত্তা নিয়ম-নীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। প্রচলিত প্রজননে বিষাক্ততা (Toxicity) পরীক্ষা করা হয় না, কিন্তু জিন প্রকৌশলে বিষাক্ততা (Toxicity) পরীক্ষা করা হয়।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি হলো সর্বাধুনিক জীবপ্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন ও উন্নত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীব সৃষ্টি, যা দিয়ে মানুষ সর্বোত্তমভাবে লাভবান হতে পারে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ইতোমধ্যেই সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
(a) শস্য উন্নয়নে
এই প্রযুক্তির সাহায্যে ক্ষতিকর পোকামাকড় প্রতিরোধী ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
Bacillus thuringiensis (Bt) নামক ব্যাকটেরিয়ার জিন শস্যে প্রবেশ করানোর কারণে জেনেটিকভাবে পরিবর্তিত শস্যসমূহকে Bt Corn, Bt Cotton ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হচ্ছে। একইরকমভাবে বিটি ভুট্টা, বিটি ধান (চীনে) ইত্যাদি উদ্ভাবিত হয়েছে। এসব ফসল লেপিডোপটেরা (Lepidoptera) তথা মথবর্গীয় এবং কলিওপটেরা (Coleoptera) তথা গুবরে পোকাবর্গীয় ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষম।
এই প্রযুক্তির সাহায্যে ভাইরাস প্রতিরোধী ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। যেমন ভাইরাল কোট প্রোটিনে (Coat Protein) জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে টমেটো মোজাইক ভাইরাস (ToMV), টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV) এবং টোবাকো মাইল্ড গ্রিন মোজাইক ভাইরাস (TMGMV) প্রতিরোধী ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। রিং স্পট ভাইরাস (PRSV) প্রতিরোধে সক্ষম পেঁপের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। লেট ব্লাইট ছত্রাক প্রতিরোধী জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে লেট ব্লাইট প্রতিরোধী গোল আলুর জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা চলছে।
জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে আগাছানাশক রাসায়নিক পদার্থের বিরুদ্ধে সহনশীলতাসম্পন্ন (Herbicide tolerant) ভুট্টা, তুলা ইত্যাদি ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে বিজ্ঞানীরা আগাছানাশক সহিষ্ণু জিন টমেটোতে স্থানান্তর করে আগাছানাশক সহিষ্ণু (Herbicide tolerant) টমেটোর জাত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। একইভাবে সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, ক্যানোলা (Canola) ইত্যাদির আগাছা নাশক সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে একই উদ্ভিদে একাধিক বৈশিষ্ট্য (Trait) অনুপ্রবেশ করানো যায়। বাণিজ্যিকভাবে এখন এ ধরনের ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ সহজলভ্য হয়েছে। যেমন তুলা এবং ভুট্টার মধ্যে একই সাথে আগাছানাশক সহিষ্ণু (Herbicide tolerant) এবং পোকামাকড় প্রতিরোধী (Insect resistant) বৈশিষ্ট্য অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে।
জিনগত রূপান্তরের মাধ্যমে ফসলের পুষ্টিমান উন্নয়ন করা হয়েছে। যেমন, ধানে ভিটামিন A তথা বিটা- ক্যারোটিন জিন স্থানান্তর করা হয়েছে। এই ধানের চাল থেকে প্রস্তুত ভাত খেলে আলাদা করে আর ভিটামিন A খেতে হবে না। ধানে লৌহ বা আয়রন যোগ করারও প্রচেষ্টা অব্যাহত হয়েছে। লবণাক্ততা এবং খরা সহনশীল জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে জিনগত পরিবর্তন (Genetic modification) ঘটিয়ে বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে।
(b) প্রাণীর ক্ষেত্রে
গবাদিপশু যেমন, গরুর দুধে আমিষের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য Protein C জিন স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে এটা এখনো গবেষণা পর্যায়ে আছে।
আকার বৃদ্ধি এবং মাংসের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে মানুষের বৃদ্ধির জন্য দায়ী হরমোনের জিন স্থানান্তর করে ভেড়ার জেনেটিক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। ভেড়ার পশমের পরিমাণ ও গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য ব্যাকটেরিয়ার 2টি জিন, যথা CysE এবং CysM ভেড়ার জিনোমে স্থানান্তর করা হয়েছে।
(c) মৎস্য উন্নয়নে
মাগুর, কমন কার্প, লইট্টা ও তেলাপিয়া মাছে স্যামন মাছের দৈহিক বৃদ্ধি হরমোনের (Growth hormone) জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে জেনেটিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এসব মাছের আকার প্রায় 60 ভাগ বড় করা সম্ভব হয়েছে।
(d) চিকিৎসা ক্ষেত্রে
জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ইস্ট নামক ছত্রাক থেকে হেপাটাইটিস বি-ভাইরাসের ঔষধ (ইন্টারফেরন) তৈরি হচ্ছে।
মানবদেহের ইনসুলিন তৈরির জিন ব্যবহার করে জেনেটিকভাবে পরিবর্তিত E. colt ব্যাকটেরিয়া এবং ইস্ট থেকে বাণিজ্যিকভাবে ইনসুলিন তৈরি হচ্ছে, যা মানুষের বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
জেনেটিকভাবে পরিবর্তিত E. coli ব্যাকটেরিয়া এবং ইস্ট থেকে মানববৃদ্ধির হরমোন (growth hormne) এবং গ্র্যানুলোসাইট ম্যাক্রোফাজ স্টিমুলোটিং ফ্যাক্টর (GM-CSF) বা কলোনি উদ্দীপক উপাদান ইত্যাদি তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো যথাক্রমে অস্বাভাবিক খাটো হওয়া রোগ (dwarfism), ভাইরাসজনিত রোগ, ক্যান্সার, AIDS ইত্যাদির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
(e) পরিবেশ সুরক্ষার
পেট্রোলিয়াম ও কয়লাখনি এলাকা দূষণমুক্তকরণ, শিল্পক্ষেত্রে বর্জ্যশোধন, পয়ঃনিষ্কাশন ইত্যাদি পরিবেশ ব্যবস্থাপনা সহজ এবং দ্রুত করার উদ্দেশ্যে এই প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়। জিন প্রকৌশলের উপর গবেষণা করে নতুন এক জাতের Pseudomonas ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে যা পরিবেশের তেল ও হাইড্রোকার্বনকে দ্রুত নষ্ট করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করতে সক্ষম।
একক কাজ কাজ: জীবপ্রযুক্তি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যবহার বিষয়ে পোস্টার অঙ্কন কর ও শ্রেণিতে উপস্থাপন কর। |
একক কাজ কাজ: বাংলাদেশে জীবপ্রযুক্তি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার সুযোগ সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরি কর ও শিক্ষকের নিকট জমা দাও। |
common.read_more